- মুজিবুস সামাদ
লালসালু দিয়ে সাজানো। আগে ছিল কাঠের এবং সেটা এখন কংক্রীটের সীমানায় পৃথক। উপরের টেবিলের একপাশে কলমদানী ও ‘‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’’ ছাপমারা প্যাডের কাগজ এবং অন্যপাশে কাগজের স্তুপ ও খসড়া সাদা কাগজের পেপার ওয়েটের ভার। সি.আর. মানে কোর্ট রেজিষ্ট্রেশন ফাইলের মামলাগুলো মাননীয় ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্ট প্রথমে শুরু করবে, প্রথমে হাজিরা এবং পরে পড়বে তারিখ। চারিদিকে শুধু কেইসে যারপর নাই জেরবার হওয়া, ক্লান্ত, চিন্তিত, অনাগত ভবিষ্যতের কালোতে আতংকিত ঝাপসা মুখগুলো। ডান দিকে আসামীর জায়গা কাঠের আয়তাকার লম্বা কাঠামোর সীমায় চিহ্নিত আর বামদিকে বাদীর জায়গা বর্গাকার (উঁচু বেদীর উপর) পার্টিশন দিয়ে ঘেরা। সকল দর্শক শ্রোতার চোখও ঐদিকে। তাদের চোখগুলো গোলাকার লেবেলে আটকানো থাকে না, মাঝে ও মধ্যে তাদের নজর ও মনোযোগ ঘুরে ফিরে কিছু সময়ের জন্য গোল চাকতির মত ঘুরতে ঘুরতে ঐ নির্দিষ্ট পাটাতনের দিকে লক্ষ্য স্থির হয়। আর সঙ্গে সঙ্গে কারোর কারোর ঘৃণা, ক্ষোভ, রাগ ও অভিমান নিক্ষেপিত হচ্ছে ঐ টার্গেটকে লক্ষ্য করে। যাক এই যাত্রা কিছু দিনের জন্য রেহাই পাওয়া গেল। আবারও তারিখ পড়ে গেল। সম্মানীত ম্যাজিষ্ট্রেট চেম্বারে আসার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত লোকজন দাঁড়িয়ে গেল, বসার সঙ্গে সঙ্গে সমস্তই বসে গেল। এই মুহুর্তটা পলকে কেটে গেলেও, এই যে কোর্টের বারান্দায় এতক্ষণ বিপুল সময়ের অপচয় হচ্ছে, কিংবা তার চেয়ে বড় কথা হলো দীর্ঘ প্রতিক্ষার লাইনে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিড়ম্বনার শিকার, তখন মানুষগুলোকে দেখে মনে হয় আইনের বেড়াজালে মানুষ কত অসহায়, কত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।একটা শ্যামলা মেয়ে, পাতলা গড়নের তাকেই ঘিরেই যত টেনশন। মেয়েটির নাম নাসিমা, ছোট বেলায় দূরন্ত প্রকৃতির স্বভাব যার, সে বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর নিভে গিয়েছিল। স্বামীর ঘরে গিয়ে শান্ত শিষ্ট হতে বাধ্য হয়েছিল। এ মেয়ে স্বাভাবিক অন্যান্য মেয়ের মতো গড়ে ওঠেনি। যা তার ঘর সংসারে স্বভাবগত মেয়েলী আচরণে অভ্যস্ত নয় বলে, তাকে ঘিরে সমস্যা, তাকে নিয়ে ভয়ঙ্কর ভয়, তাকে নিয়ে রীতিমত আতঙ্ক। নাসিমাকে নিয়ে বিপদজনক বড় সমস্যা, তার মনের সরলরেখায় চলে, মুখের উপর খারাপ কিছু দেখলে, বরং মুখের উপর সোজা সটান প্রতিবাদ করে, তার মুখে কোন রাখ-ঢাক নেই। তার দুষ্টমিটা নেহাত টিন এজারের (বালিকা সুলভ) মধ্যে সৃষ্টি হওয়া। তার দুষ্টমি কখনও পাগলামি পর্যায়ে উন্নীত হয়। কখনো গাছে, কখানো ছাদের কার্ণিশে বানরের মত লাফিয়ে চলে ও মুক্ত জীবন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনও পাড়ার ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা পাগলী বলে ডেকে যায়, এ সময় তাকে নিয়ে জনপ্রিয় গানের পেরোডী গেথে ফেলে - ‘‘ও পাগলী তোর পাগলা কই’’। ‘‘ও পাগলী তোর পাগলা কই’’। ক্ষেপে গিয়ে তাড়া দেয়। বাচ্চারা খুবই মজা করে, খুবই উপভোগ করে। তারপর যে যার মত সরে’ পড়ে আসর থেকে।মেয়েটার স্বামী মনিরুজ্জামান মিয়ার এটি দ্বিতীয় বিয়ে। এটাকে মোটামুটি গোপনে রেখেছে তাই নয়। এছাড়া উপায়ও নেই। বিয়ে যৌবন জ্বালা মিটানোর জন্য নয় শুধু, কারণ তার ঘুষ খাওয়া ঘুষের টাকা দিয়ে সংসারের ষ্টান্ডার্ড বজায় রাখা। সে যে ভদ্র লোকের সম্মান, রুচিবান ভদ্রলোক, জাতে ওঠা ইত্যাদি। তার মুখোস হল এগুলো। মুখ হল মিথ্যা কথা বলা (যাকে বাচ্চারা চাপা মারা বলে জানে)। অতিমাত্রায় মুখোসধারী শয়তান। মুখোসে সব কিছু সুন্দর সুন্দর মিষ্টি মাখা (যতই আড়ালে কদর্য হোক ফুলঝুরি চলে)। মদ খাওয়া ও পাড়ায় যাওয়ার আড়ালে তার ভন্ডামির কুৎসিত রূপ। পলিটিশিয়ানের মত কথায় কথায়, সুরে, কথার চাতুর্যে দর্শক মুগ্ধ করে। তার সংসারে নাসিমার মত মধ্যবিত্তের বনিবনা না হওয়ারই কথা। তবু নাসিমারা বনিবনার চেষ্টা করে। ওদিক থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায় না। কিন্তু মনিরুজ্জামান যখনই ধরা পড়ে যাওয়ার উপক্রম, তখনই বনিবনা মানামানি করে চলে। বনিবনা মানামানি করে চলা শুধুমাত্র দায়িত্ব কর্তব্য এক যেন মেয়ে মানুষেরই। প্রাচুর্যে দেখায় বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার, আসলে সে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের আগে সব কিছু গোপন রেখে, তার স্বামী তার সঙ্গে এক প্রকার জোর জবরদস্তি প্রেম করে। জোর জবরদস্তি বললে ভুল হবে, এই ধরণের মেয়েকে সে এক প্রকার মানসিক চাপ দিয়ে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে। তার অন্তরটার কথা কেউ কাছে না আসলে বুঝবেনা, যতই মুখে যদিও কথায় আচরণে একটু পাগলামির ছোঁয়া। স্বামী মনিরুজ্জামান মিয়া ঘুষের আয়ের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। তার বদৌলতে তার একটু-আধটু মদ গেলার অভ্যাস আছে। এটাকে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের নাসিমা আখতার ওরফে নাসু এর আপত্তি। ঘুষের টাকার আয়ের কথা তার ভালভাবে জানা নাই। পরে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ধরে ফেলে সে, লোকে যখন কানাঘুষা করতে থাকে। আসলে মনিরুজ্জামানের ভয়, প্রথম বিয়ে, প্রথমে বিয়ে সে করেছে অসুস্থ ও বিকৃত চিন্তা মননের ধারায়। সেটি তার কালো অধ্যায় (সেটিকে ঢাকার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী এর সরাসরি প্রত্যক্ষ কথাবার্তাকে ফিরাতে গিয়ে বিপত্তি)। দ্বিতীয় বিয়েতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেয়নি এবং স্পষ্ট কেইসটা হচ্ছে নারী নির্যাতনের। তার জন্যই প্রথমে তার স্বামী পরে তার বাপের বাড়ীর লোক মা, বাবা, ভাই ও বোন পরে শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা পর্যন্ত উভয় সঙ্কটে ও বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে। এরকম আধ পাগলা মুখরা মেয়েকে নিয়ে সমস্যা। উভয় পক্ষের লোকেরা চেয়েছিল আপোষ ও মীমাংসার করে মিলেমিশে যাওয়া। প্রথমা স্ত্রী ব্যাপারে যত সব অশান্তি ঘাটাঘাটি করতে নারাজ। বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে। তাকে ফেরানো যাবে না। উভয়ের জন্য মান সম্মানের ব্যাপার। অনেকে জানলেও নাসিমার পরিবার চেয়েছিল, মনিরুজ্জামানের সংসারে অবস্থান করে টিকে থাকুক উপায়তো নেই। বিয়েতো করে ফেলেছে। আর মনিরুজ্জামানের ইচ্ছা ছিল যেহেতু প্রথমা এসে গেছে তাকে নিয়ে ঘর সংসার করবে। কিন্তু যেহেতু নাসিমার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না সেহেতু নাসিমার পরিবারের সঙ্গে কোনদিন মনিরুজ্জামানের মিশ খাবে না, মিল হবে না। সে এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এক রকম বিয়েতো একটা করা যায়, সংসারটাকে টিকে থাকা আসল কথা। জায়েদা সংসার বনিবনা চায়, তার চেয়ে একটু স্বচ্ছলতা বেশী চায়। কারণ যে ব্যবসার মাধ্যমে তার সঙ্গে মনিরুজ্জামানের সঙ্গে পরিচয়, সেখানে ঘুষের টাকার মতই উপরি টাকার গন্ধ মাতন ছড়ানো। সেখানে সে স্বামীকে আরো উৎসাহিত করেছে। এই ধরণের আয়ের জন্য মনিরুজ্জামানের সঙ্গে জায়েদার দ্বন্ধ উপরি টাকা কম হওয়াতে। আর নাসিমার লক্ষ্য ছিল ঘুষের টাকাই অশান্তির কারণ, সে এটা ছাড়া তার সঙ্গে বনিবনা, মানামানি করে চলতে চায়। সেখানে মনিরুজ্জামান সবচেয়ে বিপরীতে। মানামানি, বনিবনা এ্যাডজাষ্টমেন্ট জোর করে হয় না। এটাকে নিয়ে ঘাটাঘাটি কারোর জন্য ঠিক নয়। মা আলেয়া বেগমের সঙ্গে তার প্রায়ই খুনসুটি লেগেই থাকত। কয়েক বার টেনে টুনে ম্যাট্রিকটাও পাশ করতে পারল না । মা যদি বলে, আজ বিকালে কোথাও বের হবেনি, সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেবে। কেন বেরোবো না। এমনকি তোমাদের মত যত্তোসব গরু ছাগলের মত বন্দী করে রাখা। মা বল, চুপ বেয়াদব। মুখে কোন রাখ ঢাঁক নেই। লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় উঠে গেছে। লেখাপড়া গোল্লায় গেছে।
ঐ একই কথার রিপিট।
খালি মুখে মুখে তর্ক বাইরে গেলে কি হয়।
বাইরে গেলে কি হয় পরে মজা বুঝবি।
খালি বাজে কথা
বাজে কথা পরে টের পাবি ।
আরো অনেকক্ষণ চলতে পারতো মা-মেয়ের তর্ক। উভয়েই অযথা কথার অপচয় মনে করে হঠাৎ মাঝখানে এসে থেমে যায়। প্রায়ই অনুষ্ঠিত হওয়া মা মেয়ের তর্ক পর্ব পাড়া প্রতিবেশী ‘‘দুই সতিনের ঝগড়া’’ বলে নামকরণ করেছে। বাইরে যাওয়া দরকার একটাই সেটা হলে প্রেমের একটা নেশা তাকে নেশাখোরের মত করে ফেলেছে এমন, তাকে শক্ত ঝাকুনি দিয়ে সেখানেই নিয়ে যায় অন্যদিকে মনিরুজ্জামানের সম্মোহনী শক্তি ভিতরের ফাকটুকুকে দক্ষতার সাথে লুকিয়ে রেখে। বাইরে মিষ্টি কথার ঝাঁঝ দিয়ে তাকেও আরো বেশী বেশী ডুবিয়ে রাখে। ঘুষের টাকার দাপট তাকে মুগ্ধ করে সবচেয়ে বেশী। সুন্দর সুন্দর উপহার কখনো শাড়ী, কখনো বিদেশী দামী সেন্ট, দামী কলমদানী, দামী থ্রী পিস তাকে মোহমন্ত্র বিস্ময়ে ঢেকে রাখে। নাসিমা হঠাৎ করে পিছন থেকে মনিরুজ্জামানের পিছনে গিয়ে দু হাত দিয়ে চোখ বেধে রাখে, বলেন তো আমি কে? মনিরুজ্জামান বহুদিনের চেনা গলা চিনতে বেগ পেতে হয়নি। সে কিছু না বলে সরাসরি নাসিমা হাত ধরে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে নাসিমার চোখ থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। চেনা না চেনার খেলা প্রায়ই হয়ে থাকে। নাসিমাকে সে সহজে ইচ্ছা করলে উপভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করতে পারতো। এখানে সে ভনিতার আশ্রয় গ্রহণ করে, পিছনে তার ভিতরের দুর্বলতা ধরা পড়ে যায়। বিয়ের আড়ালে নিজের দুশ্চরিত্রকে ঢেকে রাখে। উপর দিয়ে দেখায় শারীরিক সম্পর্ককে ঘৃণা করে এবং তথাকথিত চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রকাশে সে সচেতন। তার প্রথমা স্ত্রীর কথা, সে ঘরে এক ছেলে আছে তা যাতে কাক পক্ষী টের না পায় তার অভিনয় করে। না হলে সে মধ্যবিত্তের সরল সহজ পটপট করে ছেলেমি কথা বলা মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না। বিয়েটা আমাদের তথাকথিত উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্তের সমাজের নিরাপদ ভন্ডামীর জায়গা। মনিরুজ্জামান অন্যান্য দিনের মত আজকেও আলগা কথার পাহাড় বসায়।
অনেক দিন হয় ভায়ের ব্যবসার জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম।
তোমার দেখাশুনা করা ব্যবসা কিসের ব্যবসা (ঘুষের টাকাকে ব্যবসার টাকা বলে বৈধতা দিতে চায়)।
ভায়ের সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসা
আমারতো শেয়ার আছে
তাই নাকি (ওদিকে নাসিমার নজর দেয়ার সময় নেই)
তোমার জন্য কি এনেছি।
কি এনেছেন
চোখ বন্ধ করো
এই চোখ বন্ধ করলাম
এবার চোখ খুলো, বেছে না।
বিজ্ঞাপনের মত। চোখ খুলে চিৎকার ওয়াও এ দেখি চমৎকার ! জিনিষ হাতে তার ধরা আছে রঙীন কাগজে মোড়া ভ্যানিটি ব্যাগ। খোলা প্যাকেটের অংশ দিয়ে বোঝা যায় (এটা ভ্যানিটি ব্যাগ)। এভাবে চলতে থাকে মেলামেশার খেলাধুলা। একজন অর্থাৎ মেয়েটা মিশছে আপনমনের সরল রেখায়, অন্যজনের কোন কিছুকে আপন করে মিশছে না। একজনের হাসি প্রাণখোলা অন্যজনের হাসি গুপ্ত ক্রিমিনাল হাসি, হাসি চললে বেশ সময় ধরে। তারপর দ্রুত পট পরিবর্তন হতে লাগল। এভাবে মনিরুজ্জামান সরল মন শিশুসুলভ আচরণে যার কৈশোরেও দীপ্তমান, তাকে নিয়ে নাসিমাদের মধ্যবিত্তের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে বিয়ে করে ফেললো। তারপর দ্রুত সময় মধুর বসন্তের ক্ষীপ্র বাতাসে মেলোডি গানের সুর ঝড়িয়ে পড়ে গেল। ছয় মাসের পর তার মুখোস ছিড়ে ছিবড়ে দুমড়ে মুচড়ে খুলে প্রকাশ হয়ে পড়ল। স্বপ্ন ভঙ্গ হল। ধপাস করে মধ্য সাগরের মধ্য স্রোতের মুখে পড়ে হাবুডুবু খাওয়ার মত অবস্থা। মনিরুজ্জামান সাহেব পুরানো অভ্যাস ঢেকে রেখেছিল, থেমে থেকে আবার তা চালু করল। স্বচ্ছলতার উগ্র রূপ প্রকাশে উদ্যোগী হল। আর্থিক অনটন দূর করা নয়, আর্থিক স্বচ্ছলতার উগ্র মাতাল রূপ প্রকাশ পেতে দেরী হল না নাসিমার কাছে। প্রতিবাদে সে করেনি, তা অবশ্য বলা যাবে না। মনিরুজ্জামানের পুরানো অভ্যাসগত কারণে প্রায়ই বাড়তি আয়ের জন্য অফিস ফিরতে আটটা নয়টা দেরী হওয়া কিংবা টাকার গরমে মদ্যপ হয়ে ফেরা, সবই বিগত ছয় মাসের ধারাবাহিকতার এক ধরণের একভাবে চলতে থাকা রুটিন ওয়ার্ক।
কি ব্যাপার মদ খেয়েছো
নিরুত্তর
একটু শক্ত করে বলে এ সংসারে ওসব চলবে না। তবুও নিরুত্তর। ইচ্ছে করে এড়ানো । এভাবে এড়িয়ে গেলে বলতে বলতে থেমে যাবে আপনা আপনি
আবার প্রতিবাদ। এবার কড়া প্রতিবাদ, জোর গলায়, - মদ খেয়েছো।
এবার হাতটাকে ঝাকুনি দিয়ে বলে। আবার মদ খেয়েছো। সংসারটা কিন্তু আমার। আবার নিরব থাকার কৌশল নেয়। এভাবে বলতে বলতে থেমে যাবে এবং পরে সব কিছু মেনে নেবো। নাসিমা উল্টো ভেবেছিল, বাধা দিলে মনিরুজ্জামান মেনে নেবে। সে এরকম ভাবলেই কি হবে, তার প্রতিপক্ষ ভাবছে অন্য, সেই বরং আস্তে আস্তে সহ্য করে নিবে। মেয়ে মানুষতো, একদিন খুব মদ খেয়ে টালমাটাল অবস্থায় কোন রকম তাল সামলিয়ে ঘরে ফেরে। ইদানিং বেশী মাত্রায় বেড়ে গেছে গন্ধে বমি হওয়ার অবস্থা। নাসিমা মুখে হাত দিয়ে সামাল দিতে দিতে বলে, এটা কি ভদ্রলোকের ঘর
ভদ্রলোকের ঘর হয়েছো তো কি হয়েছে (ঝাপসা গলায় প্রত্যুত্তর)।
বেশী বাড়াবাড়ি করলে থাকবো না।
কি বাড়াবাড়ি দেখলে,
বাড়াবাড়ি মানে।
পাশের বাড়ী এডভোকেট কাজী সুলতান হোসেনকে জড়িয়ে অযথা বদনাম ছড়িয়ে নাসিমাকে ক্ষেপানো।
উকিলকে নিয়ে যখন তখন বাড়াবাড়ি হয় না।
ছিঃ বয়স্ক মুরব্বী মানুষকে নিয়ে অযথা বদনাম (হালকাভাবে জবাব দেয়) যুক্তি এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে
যাওনা উকিলের সংসারে। এ সংসার ভাল নাও ল াগতে পারে।
আবার মুরুব্বীকে নিয়ে আজে বাজে কথা। ওনাকে তো আঙ্কেল বলে ডাকি।
তাকে উত্তেজিত করানো যাচ্ছে না। মনিরুজ্জামান এবার স্বরুপে উদঘাটিত হয়। ঝগড়া লাগানোর হেতু খুজতে লাগল। নিজেই রাগান্বিত হয়ে নাসিমাকে থাপ্পড় মারে। মারতে গিয়ে ছোটখাট হাতাহাতি হয়ে গেল। মাতাল অবস্থায় দৈহিক বল যুৎসইভাবে প্রয়োগ করা গেল না। মনিরুজ্জামান মাতাল হবার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুইয়ে রাত পার করলো। আর সংসারের অশান্তিতে নাসিমার মনে দাগ কেটেছে বেশী। রাতে সোফায় শুয়েই, না খেয়ে রাত পার করলো। সকালে নিজেই গোসল সেরে অফিসে গেল মনিরুজ্জামান। অফিসে কাজ আছে বেশী তাই নাকি বলে গেল।
তার আগেও কয়েকবার সাধাসাধি পালা চলছে। গতকাল মাতাল অবস্থায় বিপদজনক কথা বলাকে, চেষ্টা হয়েছে অন্য দিকে ঢাকবার, কারণ সেদিক থেকে ঘর ভেঙ্গে গেলে তার অসুবিধা নাসিমার চেয়ে বেশী। আর নাসিমার চিন্তা নেই তার অসুবিধা সকল চিন্তারই কারণ। তার সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। বাড়ী থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় সবকিছু ত্যাগ করে এসেছে। তার বাবা, মা সহ পুরো পরিবার মেনে নেয়নি, তার অকুল পাথার। তার মাথা সব সময় উষ্ণতায় ভরপুর। সে রঙীন স্বপ্নের ঘোরে তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে আছে। তাই এখন সব উপায় শেষ, এখন একমাত্র চিন্তা সংসারটাকে টিকিয়ে রাখা ও এ্যাডজ্যাস্ট করা ছাড়া আর কোন চিন্তা নাই। চিন্তা হল মনিরুজ্জামানের বেশী। তার তথাকথিত সংসার ধর্মপালন ভনিতা মাত্র। তার সংসার স্বচ্ছলতা ও সংসার ষ্ট্যান্ডার্ড সবই মেকীর মধ্যে, নিজেই মনে মনে তাই বিশ্বাস করে না। সকালে সাধাসাধি, হাত ধরাধরি না করলে তার ষ্ট্যান্ডার্ড থাকে না। তাই কয়েকবার চলছে সাধাসাধি, হাত ধরাধরি, প্রতিবার কারেন্টে শক যেমন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় তেমনি করে নাসিমা মনিরুজ্জামানের হাতকে ধ্ক্কাা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। এ্যা শোনো নিরুত্তর। কি হল এ্যাই শোনো। বোবা মুহুর্ত! আবার বলছি এ্যাই শোনো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। কথা শুনবে না। মূর্তিমান হয়ে বসে থাকে। যেন শরীর চলে না। তাহলে তো কথা শুনবে না। তাহলে চললাম অফিসে কাজ আছে। এই সমস্ত কথাগুলো বলছে নেহাত দায় পড়ে সে। কারণ পিছনে সব জানাজানি হয়ে যায়। তার প্রথমা স্ত্রী যদি ফিরে আসে তাহলে আরো বিপদসংকুল সময় হবে। এমনিতে অনেক জানাজানি হয়ে লোক নিন্দার মুখরোচক বাণী হয়ে গেছে। আশে পাশের লোক অনেকেই জেনে গেছে। যেমন উকিল, তার কয়েকজন জুনিয়ররা একটি সহজ সরল বোকা মেয়ে কি করে টক্কর খেয়ে রাহুচক্রে পড়ে ধোকা খায়, তার নমুনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করছে। কুটনামি আলোর গতির চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। নাসিমা তার স্বামীর ঘর ছাড়িয়ে, মাঝখানের গলি ছাড়িয়ে, তারপর বাপের বাড়ির গলি ছাড়িয়ে কাহিনীর অপভ্রংশ ছড়াচ্ছে বহু জায়গায়। এক বছর হতে অল্প দিন বাকী, সর্বপ্রথম মাই আর থাকতে পারেনি। যতই ঝগড়া হোক মায়ের সঙ্গে তিনিই বাপের আড়ালে কয়েকবার খবর পাত্তা নিয়েছেন। কিন্তু সংসারে যে কর্তা, বড় গার্জেন, তিনি কিন্তু শক্ত হৃদয় নিয়ে বসে আছে। গোঁ ধরে আছে। সিনিয়র এ্যাডভোকেট তার নিজের কেনা বাড়ীর লাগোয়া একই উঠোনে গড়ে উঠা পাশের বাড়ির এ ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা ঘটেছে সবশেষে। প্রথমে তার বউয়ের মাধ্যমে ঘটেছে সংশ্লিষ্টতা। পরে উকিল সাহেবের জুনিয়ারদের সাথে হয়েছে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ। এদের একজন জুনিয়র উকিলের খুব অল্প বয়সের মেয়েকে বিয়ে করা বউ সন্তান প্রসব অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। তার নাম হল রশিদ, যার সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ হয়েছে ইতিমধ্যে। তার সঙ্গে একটু একটু নাসিমার প্রথমে বোনের স্নেহের সম্পর্ক, পরে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকবার মারধরের ঘটনাও ঘটেছে অল্প স্বল্প। উকিল সাহেবের স্ত্রী আফিয়া বেগম এসে ভালমন্দ বুঝিয়ে মিলেমিশে থাকার উপদেশ দিয়েছে, ‘‘স্বামী-স্ত্রীতে এমন হয়, এটা এমন কিন্তু ঘটনা নয়’’ এ বলেও শান্তনা দিয়েছে। কিন্তু মনিরুজ্জামান তাদের অংশগ্রহণকে মেনে নেয়নি। এজন্য পরোক্ষ দু’চারটি কথা শুনিয়েছে। জোর করে কিছু বলতে পারেনি। পিছনে তার প্রথমা স্ত্রীর কাহিনী দ্বিতীয় পক্ষের কাছে জানাজানি হয়ে যাক, তা সে চায়না। যদিও জেনে গেছে। উত্তেজনাবশতঃ গলায় বললো নাসিমা। তুমি একটা মিথ্যুক। তোমার আগের বউ আছে, তা লুকিয়ে আমাকে ধোকা দিয়ে বিয়ে করেছে।
বেশী বাড়াবাড়ি করো না। আর আপনারা যারা আছেন তারা দয়া করে সরে যান। এটা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার।
কথা কাটাকাটি হলে আসতাম না। যেখানে হাতাহাতি সেখানেই চুপ করে থাকা যায় না। (আফিয়া বেগমের কণ্ঠ ঝাঁঝালো কড়া সংলাপ হয়। আবার বলছি সরে যান (মনিরুজ্জামানের হুশিয়ার উচ্চারণ) আন্টিতো আমাকে বলেছে ঐ ছেলে তোমার নয়। এই কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে মনিরুজ্জামান। কি বললে আমার না। আফিয়া বেগম মুরুব্বী ঢঙে বলে চুপ করো চুপ করো ? মনিরুজ্জামান দোটানায় পড়ে, তার সংসার স্বচ্ছলতাও সংসার স্টান্ডার্ড টিকে রাখা খুবই মুশকিল। এগুলোকে টিকে রাখতে হলে যথাসর্বস্ব ভন্ডামির আশ্রয়ে নীরবে থাকা বাঞ্চনীয়। পাছে ধরা পড়ে যায়, এই ভয়ে থাকে সে । যার কোথাও নির্বিঘেœর জীবন নয়। এর জীবন একটি মৃত আরশোলার পাটাকে পিঁপড়ার দলে টেনে হিচড়ে খুবলে খাওয়ার মত। এত কিছুর পর মনিরুজ্জামান তার কপটাকেও ঢেকে রাখতে চাচ্ছে। তার এ অসৎ উদ্দেশ্যকে যেন সামান্য বিস্কুটের মত করে ঢেকে রেখেছিল, মনে করেছিল এতে তার সব ধরণের কপটতা ও শটতা ঢাকা থাকবে। কিন্তু এ উদ্দেশ্য ইদুরের রূপ ধারণ করে প্যাকেটের পিছন থেকে কুট কুট করে কেটে সম্পূর্ণ অবয়বে বেড়িয়ে পড়েছে। সেদিন মনিরুজ্জামান তার দুঃসম্পর্কের বিধবা খালার উসকানিতে ভীষণ রকম কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। যার ফলে তার হাত হতে তথাকথিত সাংসারিক স্বচ্ছলতা ও সাংসারিক স্টান্ডার্ড হাতছাড়া। তার কর্তৃত্ব গিয়ে পড়ে প্রখ্যাত এ্যাডভোকেট কাজী সুলতান হোসেনের হাতে। রাজনীতির পাল্টা কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করলে তা বুমেরাং হয়ে যায়। তার আগে তার প্রথমা স্ত্রী জায়েদা খাতুন যাকে সে সন্তান সম্ভবা অবস্থার সময় বিয়ে করছে। সেও এখানেও হাজির তার প্রত্যাবর্তনের দশ দিনের মাথায় তার প্রত্যক্ষ মদদে মূহুর্তে ঘটে যায়। সেখানে জায়েদা খাতুন ফিরে আসার দিন তার রুদ্র রুক্ষ কুটিল রূপকে দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিল। তা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। প্রথমে ড্রইং রুমে আশ্রয় নেয়, পরে আস্তে আস্তে মূল বেডরুমের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। তার রাজনীতির কুট কৌশলের কাছে নাসিমা পেরে উঠতে পারে নাই। মনিরুজ্জামান জায়েদা খাতুনকে সংগ্রহ করেছিল, প্রথম প্রথম যে ভাড়া করা বাড়ীতে মনিরুজ্জামানের নূতন নূতন আসা যাওয়ায় আর ব্যবসার আরও নূতন নূতন আসা দুজনের ভাল করে তরিকাকে রপ্ত করার আগে একদম প্রথম দেখায় ভাল লেগেছিল। তার কথাবার্তা তার মেলামেশা। তখন মনিরুজ্জামান সবেমাত্র লোকাল গভর্মেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসে চাকুরীতে ঢুকেছে। কাঁচা টাকার গন্ধে তার মন আনচান করছিল। আর জায়েদা খাতুন আসলে বস্তিবাসী সুন্দরী মহিলা। গার্মেন্টেসে চাকুরী দেবার কথা বলে, নিয়ে গিয়ে তার পাতানো খালাতো ভাই তার ঐ সর্বনাশ করেছে। তাকে ঐখান থেকে নিয়ে পালিয়ে যেয়ে চট্টগ্রামে গিয়ে বিয়ে করে। সেখানে উর্দ্ধতন কর্মকর্তার এক প্রভাবশালী রাজনৈতিকের প্রভাব খাটিয়ে তা টিকিয়ে রাখে প্রায়ই দুই তিন বছর। তার টাকার গরমে, তার মদ্যপানের বেকায়দায় পড়ে, জায়েদাকেও মারধর খেতে হয়েছে। যেদিন বেশী মারধর খেতে হয়েছে, সেদিন সহ্য করতে না পেরে, একলাই চলে যেতো, সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা একলা ফেলে রেখে যেতো। মায়ায় মমতায় ভীষণ বাধা দিল। সেখানেও রঙীন স্বপ্ন নিয়ে গেল, তাতে তার স্থান হয় নাই। কারণ দীর্ঘ পাঁচ বছর তখনকার বাড়ীওয়ালীসহ সকলে ক্রমাগত পুলিশের ধাওয়া, মাস্তানের চাঁদা, সামাজিক ধাওয়া খেতে খেতে বাড়ী পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। বিধিবাম তার ভাগ্য রচিত হল অন্য ও মোটামুটি সুস্থভাবে। বাধ্য হয়েছে তার আরেক আপন খালাত ভাইয়ের বউয়ের আশ্রয়ে আশ্রিতা হতে হয়। তার খালাতো ভাই ওয়েল্ডিং এর চাকুরী নিয়ে বিদেশে আছে। বস্তির খালাত ভাইয়ের বউ সহ আরো অনেক মহিলা, এতদিন ধরে বিবাহিত মহিলার একটা বাচ্চাসহ সংসার থেকে বিচ্যূত হয়ে অবস্থান ভাল চোখে না দেখলেও এবং কেউ কিন্তু তাকে নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে বসবাস করাটাকে পর নিন্দনীয় বিষয়ে মনে করছে। তাই তারা স্বামীর ঘরে যতই অত্যাচারিত হোক সেখানেই হল তার সঠিক স্থান। সেটা সবচেয়ে শোভনীয়। এ জন্য তারা তাকে উৎসাহের সাথে আশ্বাস দিয়েছে। স্বামীকে বুঝবার জন্য সার্বিক সহযোগিতার সাহস যুগিয়েছে। তবু ফিরে যেতে হবে স্বামীর সংসারে। জ্বলে পুড়ে ছাড়খার। সতীনের সাথে সংসার করা যায় না। প্রথমে সতীনের সঙ্গে ঝগড়া করতে তার সাহস ছিল না, কিন্তু সাহস যুগিয়েছে স্বামীর দুর সম্পর্কীয় খালা ও আরো অনেকে। সতীন একজন মধ্যবিত্ত অবস্থানের মেয়ে মানুষ। আর সে হল বস্তিবাসী। দ্বন্ধমুখর ঝড়ঝঞ্জা উঠাতে পেরেছে তবু শেষটা কোথায় দাঁড়ায়। এখন ইন্ধন যোগাচ্ছে সেই মনিরুজ্জামানের অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার একজন প্রভাবশালী ক্ষমতাধর নেতার হাত। নাসিমাকে বাধ্য করা হল। সিনিয়র উকিল সাহেবের স্ত্রীর আশ্রয় প্রশ্রয়ে যেতে। এতোবড় সাহস বস্তিবাসীর, আমি দেখে ছাড়বো। এর সঙ্গে যোগ হয় জুনিয়র উকিল রাশিদুলের গর্জে ওঠা। সেকি তোমার ঘরে এমনি এমনি এসেছে। তুমি না নিয়ে আসলে এমনি এমনি হয়েছে সব।
আফিয়া খাতুন বলে, - ও আমার মেয়ের মতো। সোজা সরল মেয়েটাকে এভাবে তাড়িয়ে দিলে। রাশিদুলের মাথায় গরম হাওয়ায় আরো উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। শালা হারামজাদা, বিয়ে করার শখ তোমাকে দেখাচ্ছি। আরেক জুনিয়র মাহবুব এসে যোগ দেয়। মনে করছো মেয়েটার পিছনে কেউ নেই। শালা প্রথমা স্ত্রীর পারমিশন ছাড়া বিয়ে করেছো। তোমাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো। আরেক জুনিয়র শরীফ বলে শালাকে নারী নির্যাতনে কেইসে ঢুকিয়ে দিবো। বুঝবে কত ধানে কত চাল। মনিরুজ্জামানের ঘর থেকে জায়েদা, মনিরুজ্জামানের খালা আরো অনেক বস্তিবাসী মহিলা উকিল সাহেবের বাড়ী লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার মত করে গালি ছুড়তে লাগল। সব কথা বুঝা গেল না। কিন্তু সিনিয়র উকিল তবুও শান্ত শিষ্ট ভদ্রোচিতভাবে নীরব রইলেন। তার ধীর স্থির সিদ্ধান্ত হল প্রথমে মনিরজ্জামানকে শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করতে বলা, না হলে অগত্যা যুদ্ধ। কিন্তু শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হল না। উল্টো সিনিয়র উকিলের সাথে নাসিমার অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে দুর্ব্যবহার করে ছাড়ল। সিনিয়র উকিল সাহেব কয়েকবার ব্যাপারটাকে মিটিয়ে ফেলার জন্য মিটিং সিটিং এর ব্যবস্থা করে। উল্টো মনিরুজ্জামানের পক্ষের লোকেরা রাজনীতির অসাধু প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে শক্তি প্রয়োগ করতে লাগল। উল্টো মনিরুজ্জামানের লোকেরা নাসিমার বাপের বাড়িতে গিয়ে, লোকদের উস্কানি দিচ্ছে, স্থানীয় ঢাকাইয়া এবং শুদ্ধ বাংলায় অশুদ্ধ উচ্চারণের মিশ্রণ, - আপনার মেয়ে সতীনের ঘর করবার পারবে না, মাগার ঠিক হইবো না। তারে তালাক দিয়া ঘরে নিয়া আসেন। মাগার সেটাই ভালোই হইবো। নাসিমার বাবার এই ব্যাপারে এদের সঙ্গে কথা বলবার ইচছা করছিল না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছেন বিক্ষিপ্তভাবে। মাই প্রথম কথা কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, ওর বাবা বিয়ে মেনে নেয়নি। আমরাও মেনে নেয়নি। ও আমাদের কথা শুনলো না। জুটে যাওয়া মাস্তান ধরণের লোকদের নাসিমার মায়ের দীর্ঘ আস্ফালন শুনতে ধৈর্য্য হচ্ছিল না। তাদের একজন নেতৃস্থানীয় বলছে, মেয়েকে বাচাতে হইলে আপনাদেরকে আসতে হইবে। নাইলে ভিতরে ভিতরে জলত্যাছে। ছাংঘাতিক! নাসিমার মা ও বাবাকে এই মুহূর্তে তাদেরকে দলে টানার জন্য বিভিন্ন রকম সহানুভূতিশীল কথা এমনকি মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বলছে তারা এবং উকিলের সংশ্লিষ্টতার কথা বলতে ছাড়ছে না। আসলে এদেরকে মনিরুজ্জামানই পাঠিয়েছে। আসলে মনিরুজ্জামান বাচ্চাটা অমানুষ, এসমার্ট না। ভদ্র ঘরের মেয়েটারে ভাগাইয়া নিয়ে গেল। জবাবে আমরা কি করবো। মায়ের খোদোক্তি। আপনেরা কি করবেন আপনেরা জানেন না, ওর আগের ঘরের বউয়ের বাচ্চা ভি আছে, বউটা শালা বাজারীয়া মেয়ে মানুষ। ওর সঙ্গে আপনার ম্যাইয়াটা পারবো না। যা করবার তড়তড়ি করেন। আবার শালা উকিল জোটায়াছে। বুঝলেন উকিল এক নম্বর টাউট বাটপার। কেইছের মধ্যে ঢুকলে বহুত মুছিবতের মধ্যে পড়ব্যান। বহুত কেলেংকারী হইয়া যাবো। ওই উকিল যত খারাপ বুদ্ধি দিতেছে বলছে নারী নির্যাতনের কেইস করবো। জেলের ভাত ভি খাওয়ায়ে ছাড়বো। আপনার মাইয়াটা বোকা সোকা মানুষ। সোজাডা বুঝে, তেরা বেকা বুঝে না। এতক্ষণ ধরে নাসিমার বাবা পিছন থেকে মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন। গুন্ডা-পান্ডা যাই হোক এতক্ষণ যে কথাগুলো বলছে তারা, সেগুলো চিন্তাশীল মানুষের কথাই বলছে, উনার কাছে হুবহু তাই মনে হল। এবং সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা নরম হয়ে গেল। উনার মনটাও। তিনি নম্র সুরে বললেন, কি করবো বাবারা বলতো, এই আমিতো মেনে নিবোনা। তার মায়ের কান্নাকাটির চোটে, ইনডাইরেক্টলি তার মায়ের কথা তাকে ঐ সংসার থেকে চলে আসতে বলেছি কয়েকবার, সে আসবে না। মেয়েটার আসলে একটুও বুদ্ধি সুদ্ধি নেই। হোমজিক্যাললি একাজটা করেছে । আসবে না, সেখানে তার জিদ টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু দিন তাকে অবস্থান করতে হবে। সে নাকি সিনেমা হিরোইনদের মত শেষ দেখে ছাড়বে। গুন্ডা পান্ডার কথায় উকিল সাহেবের ঘেরাটোপে থেকে মুক্তি করতে গিয়েছিলো নাসিমার মা, নাসিমার এক খালা এবং খালাতো বোন। আনতে পারে নাই ফিরিয়ে। কারণ তাদের মেয়ের ভিতরে এমন সব জীবাণু কাজ করে যে, কোন প্রকার মেয়েলী কেলেংকারী ও অশান্তি ছাড়া তাদেরকে বাঁচতে দিবে না। তাদের ব্যর্থ অভিযান অধ্যাপক সাহেবকে ভাবিয়ে তুলছে ক্রমাগতভাবে। ভাবিয়ে তুলেছে উনার স্ত্রীকে, উনার দুই মেয়েকে, দুই মেয়ের জামাইকে, শালাকে, শালীর মেয়েকে, মোদ্দাকথা পুরো পরিবারকে। শুধু এ পরিবার কেন? একসঙ্গে মনিরুজ্জামান ও সিনিয়র উকিল সাহেবের পরিবারদেরকে সমানভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। একে তো মেয়েলী কেলেংকারী ও অশান্তি, তার মধ্যে আবার দেশের প্রখ্যাত সিনিয়র উকিলের ক্রিমিন্যাললি জিলাপীর ঘোর-প্যাচ, পাড়াসুদ্ধ সবাই অবজ্ঞাত। দুই পরিবারের ঘুম হারাম হয়েছে, ভাবিয়ে তুলছে ভয়ঙ্কর রূপে। এত কুৎসিত হতে পারে উকিলের জেরা! জেরার পাল¬ায় পরে পরিবারের ভিতরকার যত রকমের বদনাম, কলঙ্ক, দুর্নাম সহ এ ধরণের যত কুৎসিত জিনিষ নাকি টেনে-হিচড়ে বের হয়ে আসবে। মান-সম্মান, মান ইজ্জত একদম ধুলায় মিশে যাবে। তারপর ঐ রকম সহজ সরল, যার ভিতরে কোন গরল, প্যাচ, ফাঁক-ফোকর নেই। মেয়েটার একটাই বিরাট দোষ মুখে মুখে অনবরত কথা বলে, কোন রাখ-ঢাক নেই। কোন কথা গোপন থাকে না। মুখে মুখে অনবরত কথা কাটাকাটি ও রাগারাগি, জেদাজেদি লেগে আছে। ভিতরে কোন ফাঁক-ফোকর, প্যাঁচ রাখে না। ভিতরটায় একদম পরিস্কার, কিন্তু মুখে কথা বলতে বাজে না। তাকে ঘিরে আজ দুই পরিবারের বিশাল চিন্তা চেতনার বিষয়, ঘাবড়াবার বিষয়। সিনিয়র উকিল নারী নির্যাতন ও শিশু নির্যাতনের কেইসের জন্য প্রথমে উকিল নোটিশ দেয় এবং পরে তা কেইসে রূপান্তরিত হয়। এদের দোষ এরা জেদাজেদি বসে উকিল নোটিশের জবাব পর্যন্ত দেয় নাই। উল্টো আরোও উকিলকে ভয় দেখানোর জন্য নাসিমার নামে তালাকনামা পাঠিয়ে দেয়, যা তাদের অদুরদর্শীতার ও অপরিণামদর্শিতার কাজ হয়েছে। কেইসের ফলাফল কি হবে, সেটা পরের কথা। কেইসের আর্গুমেন্টে কি প্রকার বীভৎস - ভয়ঙ্কর কুৎসিত রূপ ফুটে উঠবে, তাই নিয়ে তারা শঙ্কিত। এ রকম নির্বুদ্ধিতার কাজ কেউ কি করে? কেইসের কয়েকটা তারিখ ইতিমধ্যে পড়ে গেছে। আগামী তারিখে চুড়ান্তভাবে শুনানীর জন্য দিন ধার্য্য করা হয়েছে। কেইসের শুরু থেকে এই পর্যন্ত মানসিক যন্ত্রনার যে অশ্বস্তি, দুঃশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্নের কালো বিভীষিকায় এরা জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়েছে, তা ভয়াল রোজ কেয়ামতের চেয়ে বুঝি বেশী। জ্বলেও শেষ হচ্ছে না, পুড়েও শেষ হচ্ছে না। কন্টিনিউয়াজ চলতে আছে। প্রায় প্রতিদিনই যাচ্ছে এদের হতাশার দিন, উদ্বিগ্নের দিন, অশ্বস্তির দিন, অরুচির দিন ও নূন্যতম শান্তি বিঘেœর দিন। প্রতিদিন তারা প্রত্যেকেই স্বপ্নের ফানুষ উড়াচ্ছে। নাসিমার মা-বাবা স্বপ্ন দেখছে; সে জায়েদাকে সরিয়ে মনিরুজ্জামানের সংসারের রানীর আসনে বহাল আছে। জায়েদা স্বপ্ন দেখছে নাসিমাকে সরিয়ে সংসারে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। মনিরুজ্জামান দেখছে, উকিল কেইসে হেরে যাচ্ছে। উকিল দেখছে, মনিরুজ্জামানের হাতে হাত কড়া পড়ানো হচ্ছে। জুনিয়র উকিল দেখছে নাসিমা তার ঘরের বউ হয়ে আসছে। কিন্তু কেইসের রায় এখনও অনেক অনেক দিন বাকী।
0 Comments